Sunday, August 23, 2009

ইসলামে ভারসাম্য ও মিতব্যয়

পাঠক! গত আসরে আমরা বলেছি, ইসলামে অপচয় ও অপব্যয় উভয়ই নিষিদ্ধ। অপচয় ও অপব্যয় যে পরিবার ও সমাজে আর্থিক দৈন্যতা বাড়ায়, তা নিয়েও আলোচনা করেছি। আসলে অপচয়ের কারণে মানুষ শুধু আর্থিকভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেনা, এর ফলে মানুষের শরীর,মন ও আত্মাও অপুরণীয় ক্ষতির মুখে পড়ছে। আজকের আসরে আমরা এ সম্পর্কেই বিস্তারিত আলোচনা করবো।

ইসলামী অর্থনীতিতে অপচয় ও অপব্যয় কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। অপচয় বা অপব্যয় শুধু যে আর্থিক ক্ষতিই ডেকে আনে তা কিন্তু নয়। অপচয়ের কারণে আর্থিক ক্ষতির চেয়েও আরও অনেক বড় ক্ষতি হতে পারে মানুষের। মানুষের আয়ু নির্দিষ্ট। একজন মানুষ সর্বোচ্চ ১২০ থেকে ১২২ বছর বেঁচে থাকে। আর মানুষের গড় আয়ু প্রায় ৬০ থেকে ৭০ বছর। কাজেই জীবনের প্রতিটি মুহুর্তই অতি মূল্যবান। কেউ যদি তার এই সময়টাকে সঠিক ভাবে কাজে না লাগিয়ে তা অবহেলায় কাটিয়ে দেয়, তাহলে এর চেয়ে ক্ষতিকর আর কিছুই হতে পারে না। বর্তমানে আমরা নানাভাবে সময় অপচয় করছি। বাংলাদেশ ও ভারতের মতো দেশগুলোর বড় বড় শহরের মানুষজনের এখন প্রতিদিনের একটা উল্লেখযোগ্য সময় কাটে ট্রাফিক জ্যামে পড়ে। এজন্য ব্যক্তির চেয়ে সরকারের অব্যবস্থাপনাই বেশি দায়ী। তবে জনগণের যেহেতু ভোট দিয়ে সরকার নির্বাচনের অধিকার রয়েছে, সে কারণে কেউই এর দায় এড়াতে পারবে না। অনেককেই কম্পিউটার গেইম খেলে, ইন্টারনেট ব্যবহার করে এবং টেলিভিশন দেখে সময় কাটাতে দেখা যায়। অনেকে এক্ষেত্রে নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, প্রতিটি মানুষেরই বিনোদনের প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু মাত্রাতিরিক্ত কোন কিছুই শুভকর নয়। আসলে মানুষের জীবনের একেকটি মুহুর্ত একেকটি সুযোগ। কারোরই উচিত নয় একটি মুহুর্তও অপচয় করা।

মানব সম্পদ ও শক্তিকে সঠিক উপায়ে ব্যবহার না করাও এক ধরনের অপচয়। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, একজন ব্যক্তি যে কাজে অধিক পারদর্শী তাকে দিয়ে সে কাজ না করিয়ে অন্য কাজ করানো হচ্ছে অথবা অধিক পারদর্শী লোককে উপযুক্ত কাজে নিযুক্ত করা হচ্ছে না। এর মাধ্যমে অপব্যয় ও অপচয় বেড়ে যাচ্ছে। দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার অভাবে অনুপযুক্ত স্থানে চাকুরি পাওয়া ব্যক্তিরা অনিচ্ছাকৃত ভাবে সম্পদ অপচয় করছে। পানি, বিদ্যুৎ ও জ্বালানী ব্যবহারের ক্ষেত্রে সতর্ক না হবার কারণে প্রতি বছর ব্যাপক অপচয় হচ্ছে। এছাড়া, অব্যবস্থাপনা ও অবহেলার কারণে প্রতিদিনই বহু খাদ্য ও জিনিসপত্র নষ্ট হচ্ছে।
ধুমপানসহ সব ধরনের নেশাই মারাত্মক অপব্যয়। এর ফলে স্বয়ং ধুমপায়ী বা মাদকসেবীর পাশাপাশি তার আশেপাশের মানুষও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। স্বাভাবিক ভাবেই যা কিছু মানুষের জন্য ক্ষতিকর তার সবই অপচয় ও অপব্যয় হিসেবে গণ্য। রাসূল (সাঃ)-র পবিত্র বংশধর ইমাম সাদেক (আঃ) বলেছেন, যা আর্থিক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায় এবং শরীরের ক্ষতি করে,তাই অপচয়।

অপচয় ও অপব্যয়ের নানাবিধ ক্ষতিকর প্রভাবের কারণে ইসলামে তা নিষিদ্ধ। অপচয় ও অপব্যয়ের কারণে বৈষয়িক ক্ষতির পাশাপাশি আত্বিক ক্ষতিও ঘটে। এর আগেও আমরা বলেছি, বেশি বেশি খাবার খেলে স্বাস্থ্যগত নানা সমস্যা দেখা দিতে পারে। রাসূল (সাঃ) বলেছেন, পেট হলো সকল রোগের বাসা এবং মাত্রাতিরিক্ত খাদ্য গ্রহণ থেকে বিরত থাকাই হলো সর্বোত্তম ওষুধ। রাসূল (সাঃ) আরও বলেছেন, "অতিরিক্ত খাদ্য গ্রহণ থেকে বিরত থাকুন, কারণ তা মানুষকে নিষ্ঠুর করে তোলে এবং দেহের অঙ্গ প্রতঙ্গ আল্লাহর নির্দেশ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অলস হয়ে পড়ে ও সদুপদেশ শ্রবণে অনীহা সৃষ্টি হয়।'
ভোগ-বিলাসিতা মানুষের দেহের চেয়ে আত্মার উপর বেশি নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। অপচয় ও অপব্যয়ের কারণে বরকতও হ্রাস পায়। এর ফলে মানুষের ধন-সম্পদ ক্রমান্বয়ে হ্রাস পায়। ইমাম সাদেক (আঃ) এ সম্পর্কে বলেছেন, অপচয় ও অপব্যয় বরকত কমিয়ে দেয়।

মানুষ আল্লাহর নেয়ামতের অবজ্ঞা ও অবহেলা করে নিজের জন্য মারাত্মক বিপদ ডেকে আনে। পবিত্র কোরআনের সূরা মুমিনের ২৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, 'নিশ্চয় আল্লাহ্ অপচয়কারী ও মিথ্যাবাদীকে পথ প্রদর্শন করেন না।' ইমাম আলী (আঃ) এ সম্পর্কে বলেছেন, ঐসব অপব্যয়কারীর উপর ভর্ৎসনা যারা অপব্যয়ের মাধ্যমে নিজেকে সংশোধনের পথ থেকে সরিয়ে নিয়েছে। অপচয়কারীরা সৎ কাজের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে কারণ অপচয়ের মাধ্যমে সে ক্রমান্বয়ে ভালো কাজ করার সক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। এছাড়া, অপচয়কারীর দোয়া আল্লাহ কবুল করেন না। ইমাম সাদেক (আঃ)-র মতে চার শ্রেনীর মানুষের দোয়া আল্লাহ কবুল করেন না,ঐ শ্রেণীর একটি হলো, বিনা কারণে অর্থ অপচয়কারী ব্যক্তিবর্গ যারা অপচয়ের মাধ্যমে সব শেষ করে আল্লাহর কাছে জীবিকা প্রার্থনা করে। আল্লাহ এ ধরনের ব্যক্তিদের কাছে বিচার দিবসে কৈফিয়ত চাইবেন। আল্লাহতায়ালা বলবেন, আমি কি তোমাকে মধ্যপন্থা অবলম্বন করতে বলিনি ? আমি কি তোমাকে ব্যয়ের ধরনে সংশোধন আনতে বলিনি ?

অপচয় ও অপব্যয়ের চূড়ান্ত পরিণতি হলো দারিদ্র্য। এ সম্পর্কে রাসূল (সাঃ) ও ইমামদের অনেক হাদিস রয়েছে। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) বলেছেন, আল্লাহ অপচয়কারীকে অভাবগ্রস্ত করেন। আসলে অপচয়কারী আল্লাহর দেয়া অনুগ্রহের ব্যাপারে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ না করে যেনতেন তা অপচয় করে এবং নিজেই নিজের করুণ পরিণতি ডেকে আনে। রাসূলের পবিত্র বংশধর ইমাম কাযেম (আঃ) বলেছেন, যারা মধ্যপন্থা অবলম্বন করে ও হিসাব-নিকাশ করে চলে, তাদের জন্য আল্লাহর অনুগ্রহ বিরাজমান থাকে, আর অপচয়কারীরা আল্লাহর অনুগ্রহ হাতছাড়া করে। আসলে অপচয় ও অপব্যয় সমাজে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি করে এবং আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে বৈষম্য প্রকটতর করে। বাংলাভাষী একজন কবি এ সম্পর্কে বলেছেন-

যে জন দিবসে মনের হরষে জ্বালায় মোমের বাতি,
আশুগৃহে তার দেখিবে না আর নিশীথে প্রদীপ ভাতি।

অর্থাৎ আজ যে অপচয়কারী ও বিলাসী, কাল সে ভিখারী ও পরমুখাপেক্ষী। এটা ব্যক্তি জীবনের মতো রাষ্ট্রীয় জীবনেও সত্য।
সব মিলিয়ে ইসলাম মানুষকে ভারসাম্য রক্ষা করে চলার উপদেশ দেয় এবং ঐশী অনুগ্রহের ব্যাপারে কৃতজ্ঞতা প্রদর্শন ও অর্থ-সম্পদের সদ্ব্যবহারের উপর গুরুত্ব আরোপ করে। মিতব্যয় মানুষের সম্পদকে বৃদ্ধি করে এবং অন্যকে সাহায্য করার পথ উন্মুক্ত রাখে। মিতব্যয়ীরা কখনোই নিঃস্ব হয় না। অপচয় ও অপব্যয়ের কারণে মানুষ ইহকাল ও পরকাল দুটোইকে হারায়। আমরা যদি রাসূল (সাঃ) সহ ইসলামের ইতিহাসের বিশিষ্ট ব্যক্তি ও মনীষীদের জীবন প্রণালী বিশ্লেষণ করি তাহলে দেখতে পাব তাদের সবাই সাদাসিধে জীবনে অভ্যস্ত ছিলেন। তারা কখনোই ভোগ-বিলাসে মত্ত হয়ে পড়েননি। অর্থ-সম্পদ অপচয় ও অপব্যয় না করে মানুষকে বেশি বেশি দান করেছেন।

আরেকটি বিষয় এখানে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি আর তাহলো, মিতব্যয় আর কৃপণতা কিন্তু এক নয়। মিতব্যয় হচ্ছে যেখানে যতটুকু প্রয়োজন ঠিক ততটুকু ব্যয় করা ও সম্পদের অপচয় না করা। কিন্তু কৃপণতা হলো, যেখানে যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু ব্যয় না করা। এ কারণে ইসলামে অপচয় ও অপব্যয়ের মতো কৃপণতাও নিষিদ্ধ। পবিত্র কোরান ও হাদিসে ক্ষুধার্তকে খাদ্যদান, বস্ত্রহীনকে বস্ত্রদান, অভাবগ্রস্তকে সাহায্য প্রদান, অনাথ-ইয়াতীমদেরকে লালন-পালন, নিঃস্ব ব্যক্তিদের উপার্জনের ব্যবস্থা করা এবং বিপদগ্রস্ত মানুষকে সহায়তা করাকে মুসলমানদের কর্তব্য বলে ঘোষণা হয়েছে। কিন্তু কৃপণরা তা করে না। এ কারণেই কৃপণতা মানুষকে জান্নাত থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরানের সূরা আল মুদ্দাস্‌সিরের ৪২,৪৩ ও ৪৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, "কি কারণে তোমাদেরকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হয়েছে? তারা বলবে, আমরা নামাজ পড়তামনা এবং আমরা অভাবগ্রস্তদের আহার্য দিতাম না।"
আসলে কৃপণ ব্যক্তিরা এমন এক গাধার মতো যার পীঠে থাকে মনি-মানিক্কের বোঝা এবং পেটে থাকে শুধু শুকনো খড়।

Source : http://bangla.irib.ir/index.php?option=com_content&task=view&id=12554&Itemid=83

No comments:

Post a Comment