Sunday, August 23, 2009

ইসলাম ধর্মে ভারসাম্যতা

সর্বশেষ ঐশী ধর্ম ইসলাম মানুষকে সুখ-শান্তি ও কল্যাণের পথে পরিচালিত করে। ইসলামের গঠনমূলক ও পরিপূর্ণ শিক্ষা সময়ের গন্ডিতে আবদ্ধ নয় এবং সকল মানুষের জন্যেই কল্যাণ-নিশ্চিতকারী। ইসলাম ধর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হলো, মানুষকে সকল ক্ষেত্রে ভারসাম্য রক্ষা করে চলতে হবে। চরম পন্থা পরিহার করে মধ্যপন্থা অবলম্বনের নামই ভারসাম্যতা অর্থাৎ কোন ক্ষেত্রেই সীমা লংঘন করা যাবে না। মানুষের বিবেক ও প্রকৃতির সাথে এর কোন বিরোধ নেই বরং বিবেকবান ও চিন্তাশীল মানুষ জীবন যাপনের ক্ষেত্রে সব সময় ভারসাম্য রক্ষা করে চলে, কখনোই সীমা লংঘন করে না। বাড়াবাড়িকে প্রশ্রয় দেয় না। যারা বিবেককে কাজে লাগায় না তারাই সব ক্ষেত্রে ভারসাম্য নষ্ট করছে। আসলে তারা অজ্ঞ। আমিরুল মোমেনিন হযরত আলী (আঃ) এ সম্পর্কে বলেছেন, অজ্ঞরাই চরমপন্থী।

সৃষ্টি জগতের সর্বত্রই ভারসাম্যতার নিদর্শন সুস্পষ্ট। কারণ আল্লাহতায়ালা তার সৃষ্টিতে ভারসাম্য রক্ষা করেছেন এবং সমস্ত কিছুতেই ভারসাম্য রক্ষার ব্যবস্থা করেছেন। মহাবিশ্বের কোনো একটি জিনিসও বিশৃংখল ও অপরিমিতভাবে সৃষ্টি করা হয়নি। পবিত্র কোরআনের সুরা আর রহমানের ৭ ও ৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, "তিনি আকাশকে করেছেন সমুন্নত এবং স্থাপন করেছেন তুলাদন্ড।যাতে তোমরা সীমালংঘন না কর তুলাদন্ডে।"

আল্লাহ যেমনিভাবে সৃষ্টিতে ভারসাম্য রক্ষা করেছেন, তেমনি সব কিছুতেই ভারসাম্য রক্ষার ব্যবস্থা রেখেছেন। ইসলাম ধর্মের শিক্ষা ও দিকনির্দেশনাগুলোও ভারসাম্যতার উপর প্রতিষ্ঠিত। ইসলামী শিক্ষায় বিবেক ও যুক্তিকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে এবং ভারসাম্য রক্ষা ও মধ্যপন্থা অবলম্বন করতে বলা হয়েছে। কাছেই ইসলামে চরমপন্থার কোন স্থান নেই। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) নিজে সব ক্ষেত্রেই ভারসাম্য রক্ষা এবং মধ্যপন্থা অবলম্বন করেছেন। রাসূল (সাঃ) একজন পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে, যুদ্ধ ক্ষেত্রে, শান্তি প্রতিষ্ঠায়, এবাদত-বন্দেগীতে এবং রাজনৈতিক অঙ্গনসহ সকল ক্ষেত্রে ভারসাম্য রক্ষা করে চলেছেন এবং কখনোই চরমপন্থা অবলম্বন বা বাড়াবাড়ি করেননি। রাসূলের আহলে বাইতের সদস্যরাও সর্বদা ভারসাম্য রক্ষা ও সীমা লংঘন না করার উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। সূরা বাকারার ১৪৩ নম্বর আয়াতে এ সম্পর্কে বলা হয়েছে, " এমনিভাবে আমি তোমাদেরকে মধ্যপন্থী সম্প্রদায় করেছি,যাতে তোমরা সাক্ষ্যদাতা হও মানবমন্ডলীর জন্য এবং রাসূল সাক্ষ্যদাতা হন তোমাদের জন্য।"

কাজেই আল্লাহতায়ালা মুসলমানদেরকে ভারসাম্যপূর্ণ জাতি হিসেবে দেখতে চায়। কোরানের অপর এক সূরায় আমরা দেখতে পাই লোকমান (আঃ) তার পুত্রকে বলছেন, "ভারসাম্যপূর্ণ আচরণ কর"। রাসূল (সাঃ) বিভিন্ন সময় মুসলমানদেরকে কথায়,কাজে ও আচরণে ভারসাম্য রক্ষার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি সব সময় মধ্যপন্থা অবলম্বনের উপর গুরুত্ব দিয়েছেন। আসলে ভারসাম্যতা ইসলামের একটি মৌলিক বিষয়। সীমালংঘন ও বাড়াবাড়িকে ইসলাম কখনোই প্রশ্রয় দেয় না,তা যদি এবাদতও হয়। যেমন ধরুন, ইসলাম ধর্মে আল্লাহর এবাদতের উপর ব্যাপক গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। কারণ এবাদত হচ্ছে, আধ্যাত্মিক পূর্ণতা ও পরকালীন কল্যাণ লাভের মাধ্যম। কাজেই আল্লাহতায়ালা এবাদতের ক্ষেত্রে অলসতা ও গাফিলতি না করার নির্দেশ দিয়েছেন। পাশাপাশি তিনি এক্ষেত্রেও বাড়াবাড়ি না করে ভারসাম্য রক্ষা করতে বলেছেন। এর অর্থ দাড়ালো, এবাদতের ক্ষেত্রেও বাড়াবাড়ি করা যাবেনা। এবাদত করতে গিয়ে অন্যান্য দায়িত্ব ভুলে যাওয়া যাবেনা। সমাজে বেঁচে থাকার তাগিদে মানুষকে কাজ করতে হবে, আয়-উপার্জন করতে হবে। যারা সব কিছু ভুলে রাতদিন শুধু এবাদতে মশগুল থাকে,তাদের কাজও পুরোপুরি সমর্থনযোগ্য নয়। খেয়াল রাখতে হবে, এবাদত যাতে স্বাভাবিক জীবনযাত্রার পথে অন্তরায় হয়ে না দাঁড়ায়। মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) এ সম্পর্কে বলেছেন, এবাদতকে বান্দাদের উপর বিরক্তিকর পন্থায় চাপিয়ে দিও না।

ইসলাম ধর্ম আধ্যাত্মিকতা ও পরকালীন জীবনের পাশাপাশি পৃথিবীর সুখ-শান্তি ও কল্যাণের উপরও গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। ইসলাম এ ক্ষেত্রেও ভারসাম্যতার কথা বলে। এমনটি নয় যে, দুনিয়াতে সুখ-শান্তি ও কল্যাণ নিশ্চিতভাবেই আখেরাতের চিরস্থায়ী সুখ-শান্তি ও কল্যাণের পথে বাধা সৃষ্টি করবে। ইসলামের দৃষ্টিতে, এ দুটি সাংঘর্ষিক কোন বিষয় নয় বরং যে কোন ভাবেই হোক এই দুইয়ের মাঝে অবশ্যই ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সূরা আল কাস্সাসের ৭৭ নম্বর আয়াতে এ সম্পর্কে বলা হয়েছে, "আল্লাহ্ তোমাকে যা দান করেছেন, তার মাধ্যমে পরকালের গৃহ ও কল্যাণ অনুসন্ধান কর এবং ইহকাল থেকে তোমার অংশ ভূলে যেও না।"
রাসূলের পবিত্র বংশধর ইমাম সাদেক (আঃ) এ সম্পর্কে বলেছেন, যারা পরকালের কারণে দুনিয়াকে পুরোপুরি ত্যাগ করেছে এবং দুনিয়ার স্বার্থের কারণে আখেরাতকে উপেক্ষা করেছে,তাদের কেউই আমাদের অনুসারী নয়।

বর্তমানে মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি করা হচ্ছে,যা সামাজিক সংকটের জন্ম করছে। পাশ্চাত্যে লাগামহীন যৌন সম্পর্ক চিন্তাশীল ও বিবেকবানদেরকে ভাবিয়ে তুলেছে। অতীতে পাশ্চাত্যে গীর্জার নিয়ন্ত্রকরা নারী ও পুরুষের মধ্যে বৈধ যৌন সম্পর্ক বা বিবাহকেও গর্হিত কাজ হিসেবে বিবেচনা করতো। যে কারণে গীর্জার পাদ্রী ও নানরা বিবাহ করার অনুমতি পায় না। তাদের এই কাজটিও ছিল এক ধরনের চরমপন্থা। কিন্তু ইসলাম ধর্ম এক্ষেত্রে বাস্তব সম্মত ও ভারসাম্যপূণ্য দিক নির্দেশনা দিয়েছে এবং মধ্যপন্থা অনুসরনের কথা বলেছে। ইসলাম ধর্ম যৌন আকাংখাকে মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি বলে মনে করে,যা মানব সমাজ টিকিয়ে রাখার জন্য অপরিহার্য। তবে এই সম্পর্ক নিয়ন্ত্রিত হতে হবে। নারী ও পুরুষের মধ্যে বিবাহ বন্ধনের মাধ্যমে এই সম্পর্ক বৈধতা পায় এবং নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আসে। এ কারণে রাসূল (সাঃ) বিয়ে করার উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন,যাতে সমাজে অনাচার ও বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে না পড়ে।

বিশ্বের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বিভিন্ন জাতি ও গোষ্ঠীর মধ্যে সব সময় যুদ্ধ-বিগ্রহ লেগেই ছিল এবং এখনও তা অব্যাহত রয়েছে। বিশ্বের কোন কোন মতবাদে যুদ্ধ ও আধিপত্য বিস্তারকে প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে। নাৎসীবাদ, ইহুদিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ এ ধরনের নীতিকে সমর্থন করে। এই নীতির কারণে এ পর্যন্ত বিশ্বে ব্যাপক বিপর্যয়কর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এর বাইরেও অনেক ধর্ম ও মতবাদ শত্রু তথা আগ্রাসীদের মোকাবেলায় আপোষকামিতা ও নমনীয়তা প্রদর্শনের উপর গুরুত্ব আরোপ করেছে। কিন্তু ইসলাম ধর্ম এক্ষেত্রেও ভারসাম্যপূর্ণ পন্থা উপন্থাপন করেছে। ভারসাম্যপুর্ণ ধর্ম হিসেবে ইসলাম, মানুষকে পারস্পরিক বিরোধ শান্তিপূর্ণ উপায়ে মিটিয়ে ফেলার আহ্বান জানিয়েছে। পবিত্র কোরআনে সকল ঐশী ধর্মের অনুসারীদের প্রতি শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও সমঝোতার আহ্বান জানানো হয়েছে। এর পাশাপাশি ইসলাম জুলুম ও অত্যারের ঘোর বিরোধী।

ইসলাম আগ্রাসী ও আধিপত্যকামী শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানায়। যুদ্ধ-বিগ্রহ বেধে গেলে কী করতে হবে, সে ব্যাপারেও ইসলাম দিকনির্দেশনা দিয়েছে। ইসলাম এক্ষেত্রে সীমা-পরিসীমা ঠিক করে দিয়েছে যাতে হিংসা-বিদ্বেষ ও যুদ্ধ আরও বেশি মাত্রায় ছড়িয়ে না পড়ে। কাজেই ইসলাম যুদ্ধের ময়দানেও ইনসাফ ও ভারসাম্যতা বজায় রাখার আহ্বান জানায়। সুরা বাকারার ১৯৪ নম্বর আয়াতে এ সম্পর্কে বলা হয়েছে, "যারা তোমাদের উপর জবরদস্তি করেছে, তোমরা তাদের উপর জবরদস্তি কর, যেমন জবরদস্তি তারা করেছে তোমাদের উপর। তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং জেনে রাখ, যারা পরহেযগার বা সংযমী, আল্লাহ্ তাদের সাথে রয়েছেন।"

ইসলাম সর্বক্ষেত্রে ভারসাম্য রক্ষার উপর গুরুত্ব আরোপ করলেও পাশ্চাত্যের দেশগুলো এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ উল্টো তথ্য পরিবেশন করছে। তারা ইসলাম ধর্মকে উগ্রতা ও চরমপন্থার উৎস হিসেবে প্রচার চালাচ্ছে। ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যমে প্রতিদিনই মুসলমানদেরকে হিংস্র ও পশ্চাৎপদ হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে। তারা এ ক্ষেত্রে আল কায়েদা ও তালেবানের মতো গোড়া ও সহিংসতাকামী গোষ্ঠীকে মুসলমানদের প্রতিনিধি হিসেবে তুলে ধরছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এসব গোষ্ঠী প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে পাশ্চাত্য ও তাদের মিত্র দেশগুলোর মাধ্যমে সৃষ্ট ও প্রতিষ্ঠিত। এছাড়া, অল্প সংখ্যক মুসলমানের অন্যায় আচরনের মাধ্যমে কোটি কোটি মুসলমানকে উগ্রবাদী হিসেবে তুলে ধরা কখনোই যুক্তিসঙ্গত হতে পারে না। আসলে ইসলামের প্রকৃত বাণী উপলব্ধি করতে হলে এর মূলে যেতে হবে। বিপথগামীদের মাধ্যমে ইসলামের শিক্ষা ও মূল্যবোধকে উপলব্ধির চেষ্টা করা হলে এ ব্যাপারে ভুল বুঝার আশংকা শতভাগ।

ইসলামের দৃষ্টিতে শান্তি ও কল্যাণের সরল পথ হলো ভারসাম্যতা। চরমপন্থা সব সময় মানুষকে সঠিক পথকে বিচ্যুত করে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, মুসলমানরা সকল ক্ষেত্রে ভারসাম্য রক্ষার মাধ্যমে সমৃদ্ধ সভ্যতা গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিল। ইসলামের সোনালী যুগে ফিরে যেতে হলে আমাদেরকে আবারও এ পথেই এগোতে হবে। আমাদেরকে ব্যক্তিগত ও সামাজিক গোঁড়ামি, উগ্র মনোভাব, চরমপন্থা ও বাড়াবাড়ির মতো নেতিবাচক দিকগুলোকে পরিহার করতে হবে,কারণ ইসলাম ধর্ম এসবের ঘোর বিরোধী।

Source : http://bangla.irib.ir/index.php?option=com_content&task=view&id=12075&Itemid=83

No comments:

Post a Comment