Tuesday, May 26, 2009

ইসরাইলের পরমাণু বোমা ও জাতিসংঘের পর্যবেক্ষকগণ

সম্প্রতি একটি গুরম্নত্বপূর্ণ বিষয় বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। বিশ্বের শানিত্মপ্রিয় মানুষ অবাক বিস্ময়ে লড়্গ্য করেছে একটি বিতর্কিত রাষ্ট্র জাতিসংঘের প্রতি কি ধৃষ্টতাপূর্ণ আচরণ করলো। গত ৪ অক্টোবর জাতিসংঘের উদ্যোগে ১৪৫ জাতি পরমাণু সম্মেলনে মধ্যপ্রাচ্যের সকল আরব রাষ্ট্রই মধ্যপ্রাচ্যকে পরমাণুমুক্ত এলাকা হিসেবে গড়ে তোলার ওপর দৃঢ় বক্তব্য উত্থাপন করে। আরব রাষ্ট্রগুলো ও ইরান স্পষ্টভাবে তাদের মতামত প্রকাশ করে বলেছে যে, ইসরাইলের হাতে অজস্র পরমাণু বোমা মজুদ আছে যা মধ্যপ্রাচ্যের সকল আরব রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য ভয়াবহ হুমকি। সুতরাং পরমাণুমুক্ত মধ্যপ্রাচ্য গড়ে তুলতে হলে ইসরাইলের পরমাণু প্রকল্প জাতিসংঘের উদ্যোগে আনত্মর্জাতিক সর্ববেড়্গণের আওতায় আনতে হবে। কিন্তু ইসরাইল স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয় যে, তারা নিজ দেশের পরমাণু প্রকল্পে কোন আনত্মর্জাতিক পর্যবেড়্গণ বা তদারকির অনুমতি দেবে না। সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ইসরাইলের এই ধৃষ্টতাপূর্ণ বক্তব্যের কোন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত না করে নীরব থাকে। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলো কার্যত ইসরাইলের বক্তব্যকেই সমর্থন করে। এই সত্য আজ দিবালোকের মতই স্পষ্ট যে, ইসরাইলের হাতে পরমাণু বোমা থাকলে আরব রাষ্ট্রগুলো ও ইরান নিজেদের নিরাপত্তা ও আত্মরড়্গার কারণেই পরমাণু বোমা তৈরি করার উদ্যোগ নিতে পারে। এক অর্থে ইসরাইলই মধ্যপ্রাচ্যে পরমাণু অস্ত্র বিসত্মারের উস্কানি দিচ্ছে বলে মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক। যার ফলে মধ্যপ্রাচ্যে বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে পরমাণু অস্ত্র নির্মাণের অসুস্থ প্রতিযোগিতা শুরম্ন হয়ে যেতে পারে। এবং এতে শুধুমাত্র মধ্যপ্রাচ্যেই নয় বিশ্বশানিত্মও ভয়ংকরভাবে বিঘ্নিত হতে পারে।

অন্যদিকে মহাশক্তিধর দেশগুলো ইরান ও কয়েকটি উন্নয়নশীল দেশের প্রতি পরমাণু অস্ত্রের নির্মাণকারী হিসেবে দোষারোপ করছে। কিন্তু পরাশক্তিবর্গ ইসরাইলের পরমাণু প্রকল্পের আনত্মর্জাতিক পর্যবেড়্গণের কোন রকম উদ্যোগের ন্যূনতম বাক্যও উচ্চারণ করে না। এদিকে তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলো যদি পরমাণুশক্তিকে শানিত্মপূর্ণভাবে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাজে ব্যবহার করে অথবা কৃষি, শিল্প ও প্রযুক্তি উন্নয়নের প্রচেষ্টা করে সে ড়্গেত্রে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বৃহৎশক্তিগুলো ওইসব উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রতি সন্দেহের দৃষ্টি নিড়্গেপ করে। এমনকি জাতিসংঘ ও আইএইএ’র দ্বারা আণবিক চুলিস্ন প্রকল্প পর্যবেড়্গণ ও পরিদর্শনের হুমকি প্রদর্শন করে এবং কোন কোন ড়্গেত্রে তা’ বাসত্মবায়িত করে। কোন কোন দেশের প্রতি অবরোধ আরোপও করা হয়ে থাকে। কিন্তু ইসরাইলের ওই সব বৃহৎশক্তি নীরব নিশ্চুপ।

সুতরাং পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকারী মহাশক্তিধরদের দ্বি-মুখি একপেশে সিদ্ধানত্মই মধ্যপ্রাচ্যে পরমাণু অস্ত্র নির্মাণ প্রতিযোগিতার প্রধান ড়্গেত্র হলেও আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই।

প্রশ্ন হলো সত্যিই কি ইসরাইলের হাতে পারমাণবিক বোমা আছে? তবে বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য তথ্য থেকে জানা গেছে ইসরাইলের হাতে পরমাণু বোমা আছে। কেন না যে সব দেশ পরমাণু অস্ত্র বিসত্মার রোধ বা NPT (Nuclear Non Proliferation Treaty) চুক্তি স্বাড়্গর করেনি, তারা হলো ভারত, পাকিসত্মান, উত্তর কোরিয়া, কিউবা ও ইসরাইল। ভারত, পাকিসত্মান ও উত্তর কোরিয়া পরীড়্গামূলকভাবে পরমাণু বোমা বিস্ফোরণের মাধ্যমে নিজেরা পরমাণুশক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। এর মধ্যে কোন লুকোচুরি নেই। কিউবাকে কোন দেশ বা বৃহৎ শক্তি পরমাণু শক্তি হিসেবে ন্যূনতম সন্দেহের শব্দ বা বাক্যও উচ্চারণ করে না। একমাত্র বিতর্কিত রাষ্ট্র ইসরাইল যার বিরম্নদ্ধে বহুদিন থেকে সন্দেহ করা হচ্ছে, তার হাতে পরমাণু বোমা আছে। যদি ইসরাইলের হাতে পরমাণু বোমা নাই থাকবে তা’হলে সে এনটিপিতে স্বাড়্গর করলো না কেন? তার আছে ৬৫-১১২টি ওয়ার হেড এবং ইসরাইলের ড়্গেপণাস্ত্রের পালস্না ৯৩০ মাইল (১৫০০ কিঃমিঃ)। বিশ্বের পরমাণু বিশেষজ্ঞদের অভিমত, ইসরাইলের কাছে মজুদ আছে ৬০ থেকে ৪০০টি পরমাণু বোমা। অধিকাংশ পরমাণু প্রকৌশলী মরদেচাই ভানুনু এক নির্ভুল হিসাব-নিকাশের ভিত্তিতে গণমাধ্যমের কাছে প্রামাণ্য তথ্য ফাঁস করে বলেছিলেন, ইসরাইলের গোপন পরমাণু অস্ত্রভান্ডারে পরমাণু বোমা মজুদ আছে ১০০ থেকে ২০০টি। ইসরাইলের এই গোপন তথ্য প্রকাশের কারণে মরদেচাই জানুনু ১৮ বছর কারাদণ্ড ভোগ করে ২০০৪ সালে ইসরাইলের কারাগার থেকে মুক্ত হন।

এদিকে সবচেয়ে চমক লাগানো বক্তব্য দিয়েছেন নোবেল শানিত্ম পুরস্কার বিজয়ী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার। তিনি বৃটেনের ওয়েলসে অনুষ্ঠিত সাহিত্য সম্মেলনে যোগদান করেন এবং এ বছরের ২৫ মে রবিবার এক পর্যায়ে সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি বলেন, ইসরাইলের হাতে ১৫০টি অথবা তার চেয়েও বেশীসংখ্যক পারমাণবিক বোমা মজুদ আছে। জিমি কার্টার দৃঢ়ভাবে বলেছেন, ইসরাইল মধ্যপ্রাচ্যের একমাত্র পরমাণু শক্তিধর দেশ।

তাছাড়াও ইসরাইলের হাতে যদি পরমাণু বোমা নাই থাকে তা’হলে সে তার পরমাণু প্রকল্পগুলো জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে আনত্মর্জাতিক পর্যবেড়্গণের অনুমতি দিচ্ছে না কেন? যদিও ইসরাইল অন্যান্য পরমাণুশক্তিধর দেশের মতো পরীড়্গামূলকভাবে কোন পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়নি, কিন্তু ইসরাইল সর্বাত্মক পরমাণু অস্ত্র পরীড়্গা রোধ চুক্তি বা সিটিবিটি (Comprehensive Test Ban Treaty)র দুর্বলতর বৈশিষ্ট্যের পথ ধরে পরীড়্গা চালিয়ে নিতে পারে। যেমন, এই চুক্তি ধারায় কম্পিউটার সিমুলেশনের মাধ্যমে পরমাণু অস্ত্রের নিষিদ্ধ করেনি। এর ফলে পারমাণবিক শক্তিধর দেশগুলো কম্পিউটারের মাধ্যমেই তাদের অস্ত্রের গুণগতমান পরীড়্গা করে নিতে পারে। সুতরাং আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি প্রয়োগ করে ইসরাইল গোপনে তার পরমাণু অস্ত্রের পরীড়্গা করতে পারে।

সুতরাং ইসরাইল গোপন পরমাণু অস্ত্র ও আধুনিক অস্ত্র নির্মাণের ডকুমেন্টস্‌ গুপ্তচরদের মাধ্যমে সংগ্রহ করে থাকে এটা প্রমাণিত সত্য। সামগ্রিক অবস্থা পর্যালোচনা করে নিশ্চিতভাবেই ধরে নেয়া যায় ইসরাইলের পরমাণু প্রকল্পের গোপন স্থানে মজুদ আছে অজস্র পরমাণু অস্ত্র। আর উপসাগরীয় এলাকা ও মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা প্রশমিত করতে হলে এবং শানিত্ম প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে হলে অবশ্যই জাতিসংঘ, আইএইএ ও অন্যান্য সংস্থাকে নিরপেড়্গভাবে ইসরাইলের পরমাণু প্রকল্প পর্যবেড়্গণ ও তদারকি করে দেখতে হবে ইসরাইলের হাতে পরমাণু বোমা, জীবাণু ও রাসায়নিক অস্ত্র আছে কিনা। বিশ্বশানিত্মই যদি সকলের কাম্য হয় তাহলে এর বিকল্প আর কি হতে পারে?

নজমুল হক নান্নু
[লেখক- আইনজীবী ও কলামিস্ট]

ত্তথ্যসূত্রঃ দৈনিক ইত্তেফাক [অক্টোবর ১৬, ২০০৮]

No comments:

Post a Comment